সম্পাদকীয়

লড়াই হল শুরু, উৎসব হল সারা…

রোল, রোলিং, অ্যাকশন… শুরু আলো আঁধারের খেলা, চালু ক্যামেরা। হাসি মুখে মঞ্চে হাজির ‘দুই নায়ক’। গালভরা হাসিতে পোজ দিলেন তারা। ব্যস, বিতর্ক, বিবাদের অবসান। ফসিলের গা-গরম ব্যঞ্জনার পরে হাতে এল ‘দেবভাষা’-র ‘ হিম-ক্রীম’। আইসক্রীম। সুধী শ্রোতা, শিল্পাঞ্চলবাসী আনন্দ, আবেগে বলে উঠলেন, আহা ,কী আনন্দ…। কিন্তু যা দেখিলেন, যা শুনিলেন- তাহা সত্যি নয়, কহেন ‘বিদ্যাপতি’। তবে এখানে বিদ্যাপতি বলতে বিদ্বান,বুদ্ধিমান বা বিদ্বজনেদের কথাই বলা হয়েছে। যাইহোক, গৌরচন্দ্রিকা তো হল, এবারে প্রসঙ্গে আসা যাক।

প্রসঙ্গ দুর্গাপুর উৎসব। গত দশ দিন কোনও কিছুই বাদ গেল না। নাচা গানা খানাপিনা, বিতর্ক-বিবাদ- আলোচনা সমালোচনায় জমে উঠেছিল উৎসব। ‘মাতব্বরি’ বা ‘মুরুব্বিয়ানা’ ‘হুমকি’ ‘আস্ফালন’ সব উপাদানই মজুত ছিল উৎসব প্রাঙ্গণে। তা প্রায় সবই প্রত্যক্ষ করেছেন শিল্পাঞ্চলবাসী। কিন্তু উৎসবের আবছা আলোয় নরেন-কবির অলিখিত লড়াইয়ের ছবিটা নজর এড়িয়ে যায়নি বিদ্বজন, রাজনৈতিক বোদ্ধাদের। তাদের কথায়, এবার শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। পেশাদার রাজনৈতিক নেতা বনাম বণিকসমাজ। তাই যারা উৎসবের সমাপ্তির আনন্দ হর্ষে ‘শান্তি শান্তি’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করছেন কিংবা খোলা আকাশের আপাত স্বস্তিতে বুক ভরা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন- এটাই শেষ নয়। সবে শুরু। জেলার তৃণমূল রাজনীতিতে লড়াইয়ে এক সিন ট্রেলার দেখল দুর্গাপুর। এখনও ‘পুরা ফিল্ম আভি বাকি হ্যায়। তবে উৎসবের কর্তৃত্ব নিয়ে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রারম্ভিক পর্ব আগেই প্রত্যক্ষ করেছেন শিল্পাঞ্চলবাসী।

সত্যি কথা বলতে কী- এ রকম পরিস্থিতি আগে আসেনি। সক্রিয় রাজনীতির মানুষ না হলেও এডিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যবসায়ী কবি দত্তের উত্থানটা বেশ চমকপ্রদ। আর আবির্ভাব পর্ব থেকেই নিজের কর্মদক্ষতা বা মন্সিয়ানা প্রমাণে কোনও কসুরই বাদ দিচ্ছেন না তিনি। দুর্গাপুরের সার্বিক উন্নয়নে তার কর্মকুশলতার প্রসঙ্গে খোদ মন্ত্রীমশাইয়ের প্রশস্তিতে কবি দত্তের কলকাতা যোগের কথা প্রায় সকলেই শুনেছেন। সে তালিকায় অবশ্যই দলনেত্রী মমতা, তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক থাকবেনই- একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সব মিলিয়ে পেশাদার পলিটিসিয়ান না হয়েও জেলার রাজনীতিতে কবি দত্ত এখন পলিটিক্যাল সেলিব্রিটির তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছেন।

অন্যদিকে, পেশাদার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জেলায় নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কারণ নেই। পঞ্চায়েত, ব্লক থেকে বিধায়ক, জেলা তৃণমূল সভাপতি- তার রাজনৈতিক উত্তরণের ইতিহাসটাও বেশ উজ্জ্বল। আসানসোল সহ জেলার দুটি লোকসভা আসনে তৃণমূলের জয়-জয়কারে তার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে দলের শীর্ষস্তরে। এই মুহূর্তে জেলায় তার প্রতিপক্ষ বলতে কেউ নেই। অপূর্ব মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ পাড়িয়াল,তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের একদা প্রথম সারির নেতারা কার্যত স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন বলে মত অনেকের। সেক্ষেত্রে নিস্কন্টক নরেন্দ্রনাথ মনে করতেই পারেন কেউ কেউ।

কিন্তু জেলাতে কবি দত্তের উদয়ে জেলায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের জল্পনা জোরালো হয়ে উঠছে। রহস্য রোমাঞ্চের সিরিজের ফেলুদার মতো হয়তো কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, নিশ্চিন্তে আর থাকা গেল না রে, তপসে…। দলের অন্দরেই শোনা যাচ্ছে, নরেনের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কমাতে কোনও এক প্রভাবশালী মন্ত্রী কবি দত্তকে হাওয়া, অক্সিজেন জুগিয়ে যাচ্ছেন। ফলে আগামীদিনে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। তারই এক ঝলক কি দেখা গেল উৎসবে! প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।

কিন্তু এসব মানতে নারাজ শাসক নেতৃত্ব। তাদের কথায়, দলে বিভাজনের কোনও সম্ভাবনাই নেই। নরেন্দ্রনাথ ভালো সংগঠক। আর কাজের মানুষ কবি দত্ত। তারা সকলেই মমতার দলের সৈনিক। সকলেই একই পরিবারের সদস্য। ফলে দলে দ্বন্দ্ব-বিবাদের কোনও জায়গা নেই বলে মত রাজ্য সম্পাদক ভি শিবদাশন দাশুর। কিন্তু তা যে মানতে নারাজ নিন্দুকেরা। দশদিনের উৎসবের ঘটনাবলীর মিশেলে কবিগুরুর ছন্দগীতির আদলে প্যারোডি ভাঁজছেন তারা, লড়াই হল শুরু – উৎসব হল সারা…।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button