ফের কেষ্টরাজ কায়েম হবে জেলায়? সংশয়ের মেঘ শাসক শিবিরে
অবশেষে কেষ্ট-কাজল সাক্ষাৎ হল। শনিবার জেলা তৃণমূল সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে যান সভাধিপতি কাজল শেখ। কিন্তু তাতেও যে সংশয়ের মেঘ কাটছে না। অনেক প্রশ্নই এখন অধরা রয়ে গিয়েছে। ফের কেষ্টরাজ কায়েম হবে জেলায়? হৃত সাম্রাজ্য কি ফিরে পাবেন অনুব্রত মন্ডল? রাজনীতিতে ফের স্বমহিমায় ফিরতে পারবেন বীরভূমের ‘ বেতাজ বাদশা’ কেষ্ট মন্ডল? কোর কমিটিরই বা কী হবে? এ রকম বহু প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে জনমানসে। তার আপাত জেলমুক্তির খবরে যতটা উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা আশা করা গিয়েছিল, তা দেখা যায়নি। এসবই দলের কর্মী-সমর্থক বা অনুব্রত অনুগামীদের মধ্যেই সীমাবন্ধ ছিল। তার জেলমুক্তির খবরে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফেও তেমন একটা প্রতিক্রিয়া মেলেনি। এমনকি জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে সারাদিন কাটালেও দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতির সাক্ষাৎ না হওয়াতে জল্পনা আরও জোরালো হয়েছে। বন্দী অবস্থাতেও অনুব্রত মন্ডলের প্রশস্তি-প্রশংসা শোনা গিয়েছিল মমতার গলায়। তাকে বীরের সংবর্ধনা দেওয়ার নির্দেশও দেন দলনেত্রী। কিন্তু সাক্ষাৎ তো দূরের কথা, জেলা সফরে এসেও দীর্ঘদিন পরে ঘরে ফেরা কেষ্ট মন্ডলের জন্য একটি শব্দও খরচ করলেন না নেত্রী। বলতে আপত্তি নেই, প্রশাসনিক বৈঠকে ব্যস্ততার মধ্যেও মমতা-অনুব্রত সাক্ষাৎ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন অনেকেই। কিন্তু তা আর হল কই? তবে কি অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মন্ডলকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নারাজ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব? এমনটা মনে হতেই পারে। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, শরীর,স্বাস্থ্য সায় না দিলেও বোলপুরে ফিরে আসার পরেই নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রমাণ মিলতে শুরু করে জেলা কার্যালয়ে। নিমেষে কোর কমিটির পাঁচ সদস্যের সরানো হয় সেখান থেকে। পরিবর্তে মমতা, অভিষেক সহ কেষ্ট মন্ডলের ছবিতে ছয়লাপ হয়ে যায় দলের সদর কার্যালয়। রাগ বা অভিমান যাই বলি কেন- মন্ত্রী সহ দলের সাংসদ, বিধায়কদের সঙ্গেও দেখা করতে রাজি হননি জেলা তৃণমূল সভাপতি। সেক্ষেত্রে দলীয় নেতৃত্ব তার শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে মুখরক্ষা করলেও অনেকেরই মনপসন্দ হয়নি। তবে এরই মধ্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন জেলা সভাধিপতি তথা কোর কমিটির অন্যতম সদস্য কাজল শেখ। অন্য কেউ সাহস না দেখালেও প্রথমদিনেই জেলা কার্যালয় থেকে সদস্যদের ছবি সরানো নিয়ে কার্যত উষ্মাপ্রকাশ করেন তিনি। অনুব্রতর জামিনের খবরে মিষ্টিবিলি করতে দেখা গেলেও জেলা সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাতে সময় করে উঠতে পারেননি তিনি। তবে এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি নানুরের দলীয় সভায় বক্তব্যে প্রকারান্তরে কেষ্ট-বিরোধিতার স্বর প্রকট হয়েছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের। এদিকে, অনুব্রত মন্ডলের জেলমুক্তিতে অনুব্রত অনুগামী তৃণমূল কেরিম খানদের আবেগ-উচ্ছ্বাসও বেশ লক্ষনীয়। বলাই বাহুল্য, এই কেরিম খানের পরিবর্তে গত বছর প্রার্থী করা হয় কাজল শেখকে। একইসঙ্গে নানুর এলাকাতেও গত পঞ্চায়েতে আসন বন্টনে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয় কাজল অনুগামীদের। সত্যি কথা বলতে কী, অনুব্রত মন্ডলের অনুপস্থিতিতে নিজের অধিকার বা আধিপত্য বিস্তারে কোনও কসুরই বাদ দেননি কেষ্ট-বিরোধী এই যুবনেতাকে। বলতে আপত্তি নেই, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নব জোয়ার কর্মসূচীতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক উত্থানের দিন শুরু হয় বলে মনে করেন অনেকেই। পরবর্তীতে জেলা সভাধিপতির মতো পদও জোটে তার কপালে। সেক্ষেত্রে তৃণমূলের ‘ সেকেন্ড ইন কমান্ড’-এর স্নেহ-সান্নিধ্য কাজ করে। কোর কমিটিতেও বেশ গুরুত্ব তিনি। তবে কেষ্ট মন্ডল স্বমহিমায় থাকলে কাজল শেখের এতটা বাড়বাড়ন্ত হত কি না- তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। যাইহোক, এদিকে, গত লোকসভা নির্বাচনে অনুব্রত মন্ডলের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও রীতিমতো ভালো ফল করে তৃণমূল। সেক্ষেত্রে কোর কমিটির কৃতিত্বকে খাটো করে দেখতে নারাজ শাসক শীর্ষ নেতৃত্ব। বলতে আপত্তি নেই, অনুব্রত কার্যকালে জেলায় একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তিনি। শতাব্দী রায় সহ সাংসদ, বিধায়কা বা তৃণমূল নেতানেত্রীরা তাকে খুব একটা ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না। কিন্তু অনুব্রত মন্ডলের গ্রেফতারির পর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। কাগজে কলমে সভাপতি থাকলেও পাঁচজনের কোর কমিটির হাতে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চায়েত সহ লোকসভা নির্বাচনেও দলের সাফল্যে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব আদায় করে নেয় কোর কমিটি। স্বাভাবিকভাবেই কাজল শেখদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে দলে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনুব্রত মন্ডলের জেলমুক্তিতে নানা জল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে জেলার রাজনীতিতে। এখনও সক্রিয়ভাবে ময়দানে নামেননি কেষ্ট মন্ডল। কালিপুজোর ফের আগের ভূমিকায় দেখা যাবে জেলা সভাপতিকে-এমনটাই খবর। কিন্তু বর্তমান দলীয় পরিস্থিতিতে স্বচ্ছন্দভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন কি তিনি? পুরনো মেজাজে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে কতটা পরিসর তিনি পাবেন- তা নিয়ে সংশয়ের শেষ নেই। কারণ এখনই কোর কমিটি ভেঙে দিতে নারাজ শীর্ষ নেতৃত্ব। পরবর্তীতে হয়তো মিলেমিশে কাজ করার সমন্বয় সূত্র দিতে পারেন তারা। কিন্তু সমঝোতা বা আপোষের নীতি মেনে কাজল শেখদের সঙ্গে কাজ করতে সমস্যায় পড়বেন না তো তিনি? যদিও কেষ্ট-কাজলদের মুখে একসঙ্গে কাজ করার কথা শোনা গিয়েছে। তা কতটা কার্যকর হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।