ভুল করেননি মমতা
সঠিক ছিলেন মমতা। সেদিন দলত্যাগ করে অন্যায় কিছু করেননি তিনি। এতদিন পরে অন্তত এটা প্রমাণিত হল। আলোচনার শুরুটা এভাবেই করতে হল। আসলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বদলের পরিপ্রেক্ষিতে আজ মমতা বন্দোপাধ্যায়। বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন। বিষয়টা খুলেই বলি। বাংলায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে অবশেষে সরানো হল অধীর চৌধুরিকে। নতুন সভাপতি পদে অভিষিক্ত হয়েছেন শুভঙ্কর সরকার। বলাই বাহুল্য, কংগ্রেসের সভাপতি কে হবেন- তা চূড়ান্ত করবে হাইকমান্ড। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক আবহে অধীরের অপসারণে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল রাজ্যে। বলতে আপত্তি নেই যে, বেশ কিছুদিন ধরে দিল্লির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল অধীর চৌধুরির। তার রাজনৈতিক অবস্থান সহ কর্মকান্ডে চরম সমালোচনায় সরব হন দলের সর্ব ভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। পরবর্তীতে লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুরে হারের পর বেশ কোনঠাসা অবস্থায় পড়ে যান তিনি। অবশেষে রাজ্য সভাপতি পদ থেকে তাকে সরানো হল। আর তাতেই রীতিমতো জল্পনা শুরু হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। বলতে আপত্তি নেই, গত লোকসভা নির্বাচনে সর্ব ভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধিতায় সরব হন কংগ্রেস,বাম সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সে দলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু তা হলে হবে কী? রাজ্যে শাসক দল অর্থাৎ তৃণমূলের বিরোধিতায় কোনও কসুরই বাদ দিচ্ছিলেন না প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি। দিল্লিতে জোট হলেও বাংলায় তৃণমূলের বিরোধী মুখ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্টা করে ফেলেন তিনি। কিন্তু সর্ব ভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূলের সঙ্গে কোনও রকম বিরোধে আপত্তি ছিল হাইকমান্ডের। অধীরে চরম তৃণমূল বিরোধিতার কারণে অধীরকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু নিজের অবস্থান বদল করেননি তিনি। বলাই বাহুল্য, ১৯৯৬ সাল থেকে সেই মমতা-বিরোধিতার সুর নরম করতে রাজি হননি অধীর। তবে দীর্ঘ এই সময়কালে মুর্শিদাবাদে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন প্রাক্তন সাংসদ তথা লোকসভার বিরোধী দলনেতা। কিন্তু ‘ইন্ডি’ জোটের সূচনা পর্ব থেকে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন তিনি। পরে প্রবল পরাক্রম সত্বেও লোকসভা নির্বাচনে হার মানতে হয় তাকে। সেক্ষেত্রে দিল্লির রাজনীতিতে তার গুরুত্ব কমে। এবার প্রদেশ সভাপতি পদ খোয়ানোয় কংগ্রেস রাজনীতিতে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে-একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কংগ্রেস হাইকমান্ডের এ হেন পদক্ষেপে সাধারণ কর্মী সমর্থকরা দারুণভাবে হতাশ হয়ে পড়বেন- এ ধরনের ভাবনা অমূলক নয়। কিন্তু তাতে কংগ্রেস হাইকমান্ডের কিছু যায় আসে না। কারণ বাম আমল থেকেই প্রদেশ কংগ্রেস নিয়ে ভাবিত নন সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। একসময় বামেদের সঙ্গে দিল্লির কংগ্রেস নেতানেত্রীদের সখ্যতার কথা অজানা নয় কারও। রাজ্যের মানুষজন চাইলেও বাংলায় বামেদের বিরোধিতায় যথেষ্ট আপত্তি ছিল ইন্দিরা, রাজীবদের। সেই একই পথে হাঁটছেন সোনিয়া,রাহুলরাও। বাংলার ভাবাবেগ চুলোয় যাক, দিল্লির গদি অটুট থাক- কার্যত এই নীতিতেই অটল রয়েছেন তারা। কিন্তু এসবের বিরদ্ধে সুর চড়ান মমতা বন্দোপাধ্যায়। সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস সহ রাজ্যে প্রবল প্রতাপশালী বামেদের সঙ্গে লড়াইয়ের দিনগুলি মোটেই সুখের ছিল না তার কাছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরোধিতায় বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের সূচনা করেন মমতা। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে আজ তিনি শুধু বাংলাতেই নন, দেশের একজন অন্যতম নেত্রী হিসেবে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। তবে কংগ্রেস ত্যাগের পর থেকে তাকে বিশ্বাসঘাতক, বেইমান বলে অভিহিত করা হয় রাজ্য কংগ্রেসের তরফে। কিন্তু বাংলার মানুষজনের ভাবাবেগকে মর্যাদা দিতে কোনও কার্পণ্য করেননি মমতা বন্দোপাধ্যায়। সত্যি কথা বলতে কী, সেদিন যদি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠন না করতেন, তা হলে হয়তো তার রাজনৈতিক জীবনে ইতি নেমে আসত। কারণ বামেদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় তাকে বলি দেওয়া হত। সেটা বুঝেই সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন মমতা। কংগ্রেস হাইকমান্ড দীর্ঘ সময় ধরেই তাদের বাংলা বিমুখতার পরিচয় দিয়েছে। আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল রাজ্য রাজনীতিতে। অধীরের অপসারণে তা ঠারেঠারে বুঝিয়ে দিলেন কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। তবে মমতা সেদিন যা করতে পেরেছিলেন, আজ অধীর কি তাই করতে পারবেন? প্রশ্ন তো থেকেই যায়