বেআইনি বালি কারবারের বলি নিস্পাপ কিশোর! প্রশ্ন শিল্পাঞ্চলে

সংবাদ সফর, দুর্গাপুর, ১২, এপ্রিল: দামোদরের গতিপথ বদল হচ্ছে। বেআইনিভাবে বালি উত্তোলনের ফলে দামোদরের বুকে মরণখাদ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর দামোদরের এই গভীর খাতে তলিয়ে যাবে একের পর এক জীবন। রবিবার দুপুরে দুর্গাপুর নগর নিগমের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের রামপ্রসাদপুর শ্মশান ঘাটে জলে ডুবে মহঃ এহসান নামের সতের বছরের এক কিশোরের মৃত্যু ঘিরে অভিযোগ ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে শহর শিল্পাঞ্চলে। তবে কি দামোদরের বেআইনি বালি কারবারের বলি হলেন ওই নিষ্পাপ কিশোর? এমনও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে জনমানসে। যদিও এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে বেআইনি বালি উত্তোলনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসন। উল্লেখ্য, রবিবার দুপুরে চার বন্ধুর সঙ্গে স্নান করতে যায় নাজিরাবাদের বাসিন্দা মহঃ এহসান নামের ওই কিশোর। হঠাৎই রামপ্রসাদপুর শ্মশান ঘাটে দামোদরের জলে পা হড়কে তলিয়ে যেতে থাকে সে। বিষয়টি নজরে আসতেই বন্ধুরা তাকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোনরকমে ওই কিশোরকে নদের পাড়ে নিয়ে আসা হয়। প্রথমে স্থানীয় এক চিকিৎসক, পরে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। কিন্তু সেখানেই তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। এ ঘটনায় এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। একইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী বাউরি পাড়ার লোকজনেরা অভিযোগ করেন, বেআইনিভাবে মেশিন দিয়ে বালি তোলার ফলে দামোদর বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। নদের বুকে গভীর খাতের সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে বেপরোয়া কাজকারবারে নদীর অভিমুখও বদলে গিয়েছে। ওপর থেকে নদের গভীরতা বোঝা যায় না। কিন্তু সামান্য অসাবধান হলেই বিপদ ঘটবেই বলে জানান তারা। এই অভিযোগে প্রায় একই কথা বলেন ভূমিরক্ষা কমিটির সদস্যরা। কমিটির তরফে ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় জানান, দিনের পর দিন শ্রীরামপুর, রামপ্রসাদপুর সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় দামোদরের বুক চিরে বেআইনি বালি কারবারের রমরমায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে জনজীবন। এ ব্যাপারে বারবার প্রশাসনের দ্বারস্ত হয়েও কোন ফল হয়নি। তার কথায়, সরকারি নিয়ম নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবৈজ্ঞানিক ও বেআইনি বালি চুরির অবাধ রাজত্ব কায়েম করেছে মাফিয়ারা। টন টন বালি পরিবহনের জন্য দামোদরের বুকে ছাই, বোল্ডার ফেলে রাস্তা তৈরি করেছে তারা। তাতে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ অবরুদ্ধ হচ্ছে। এসবের ফলে নদনদীর চরিত্রও বদল হয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরুপ পরিবেশ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট সহ সাধারণ মানুষজনের মৃত্যুর আশঙ্কা ক্রমশই প্রকট হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে এসব কিছুই তথ্য প্রমাণ সহ সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছিল ভূমি রক্ষা কমিটির তরফে। এসব কালা কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে দফায় দফায় জেলা প্রশাসনের কাছে দরবার করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে জানান তিনি। ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, এ ধরনের বেআইনি কাজ কারবারে সরাসরি পুলিশ সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যোগসাজস রয়েছে। মোটা টাকার আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে সাধারণ মানুষজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তারা। এসবের প্রতিবাদ সহ প্রতিকারের দাবিতে ফের মঙ্গলবার প্রশাসনের কাছে দরবার করবেন তারা। এমনকি এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যুর দায় প্রশাসনকে নিতে হবে বলে জোরালো সওয়াল করেন ভূমি রক্ষা কমিটির ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়, সুমন গোপরা। আগামীদিনে মৃতদেহ নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন তারা। এ প্রসঙ্গে ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা বলেন, প্রথম দিন থেকেই পরিবেশ প্রকৃতি বাঁচাও সহ গোপালমাঠ এলাকার জনজীবন রক্ষায় সর্বতোভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছে ভূমি রক্ষা কমিটি। এসবের ফলে কমিটির সদস্যদের চরম পুলিশি হেনস্থা সহ মিথ্যা মামলা মোকদ্দমার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি তাদের। এবার এসবের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে বলে জানিয়ে দেন ধ্রুবজ্যোতি, সুমনরা। বলাই বাহুল্য, দীর্ঘদিন ধরে দুর্গাপুর নগর নিগমের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের গোপালমাঠ এলাকায় বেআইনিভাবে দামোদরের বালি কারবারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তরফে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলনও কম হয়নি। কিন্তু স্রেফ কাগুজে আশ্বাস ছাড়া প্রশাসনের তরফে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ নতুন নয়। এ সংক্রান্ত নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সবুজ সফরের পোর্টাল সহ পাক্ষিক সংস্করণে। কিন্তু এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়ায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ তাদের অসহায়তার কথা ব্যক্ত করেছেন একান্ত আলাপচারিতায়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে কোন অদৃশ্য শক্তির মদতে এ ধরনের বেআইনি কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন তারা? সরকারি রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে। নদনদীর স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হচ্ছে। এমনকি এসবের ফলে সাধারণ মানুষজনের মৃত্যুর আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ধরনের বালি, কয়লা, লোহার বেআইনি কারবারিদের বিরুদ্ধে করা ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। তবে এর পেছনে রহস্য কী? এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে শহর শিল্পাঞ্চলে।