শিল্পাঞ্চল

সৃষ্টিশ্রী মেলার উদ্বোধনে উপেক্ষিত বিশ্বখ্যাত বিক্রম!

সংবাদ সফর, দুর্গাপুর: সৃষ্টিশ্রী মেলাতে উপেক্ষিত বিক্রম? সুরসঙ্গীতের সৃষ্টিশীল শিল্পীকেই দেখা গেল না প্রদীপ প্রজ্জ্বলন সহ মেলার উদ্বোধনের মূল অনুষ্ঠানে? শিল্পসংস্কৃতির শহরে এমনই প্রশ্ন তুলেছেন সঙ্গীতপ্রেমী মানুষজনেরা। অথচ এক উঠতি নায়িকাকে ঘিরে শুক্রবার সিটি সেন্টার সংলগ্ন দুর্গাপুর হাটে মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যে উৎসাহ, উন্মাদনার ছবি ধরা পড়ল, তার কিয়দংশ যদি বিশ্ববরেণ্য তবলাবাদক বিক্রম ঘোষকে নিয়ে দেখা যেত তা হলেও হয়তো কিছুটা মুখরক্ষা হত। কিন্তু তা আর হল কই?

কিছুক্ষণের মধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। এই মেলার অন্যতম উদ্যোক্তা তথা রাজ্যের মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, জেলাশাসক এস পোন্নামবালাম, এসবিএসটিসি-র চেয়ারম্যান সুভাষ মন্ডল, সভাধিপতি বিশ্বনাথ বাউরি, এডিডিএ চেয়ারম্যান কবি দত্ত, দুর্গাপুর নগর নিগমের মুখ্য প্রশাসক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় সহ প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিরা মঞ্চে আসন দখল করেছেন। তার সঙ্গে ছোট, মাঝারি নেতানেত্রীরাও জায়গা করে নিয়েছেন। মঞ্চ জুড়ে শুধুই মাথা আর মাথা। সকলেই বিশিষ্টজনের তালিকাতেই রয়েছেন নিশ্চয়ই! তখনও পান্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এসে পৌঁছাননি।

কিছুক্ষণ পরেই মঞ্চে এলেন নরেন্দ্রনাথ। সঙ্গে ‘খাদান’ খ্যাত নায়িকা ইধিকা। ব্যস, আর দেখে কে! রুপালি পর্দার রুপসীদের নিয়ে সাধারণ মানুষজনের আবেগ, উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু মঞ্চে ইধিকার উপস্থিতিতে মঞ্চের বিশিষ্টজনেদের মুখে-চোখে বা ভাবভঙ্গিতে চাপা আন¨, উচ্ছ্বাসের ছবি ধরা পড়ছিল। হাতের কাছে ‘খাদান-কিশোরী’-কে পেয়ে ‘আহ্লাদে আটখানা’ নয়, আটচল্লিশখানা হওয়ার জোগাড় হয়েছিল তাদের। এমনই কিছু টুকরো মন্তব্য শোনা যাচ্ছিল বেরসিক(!) ছিদ্রান্বেষী দর্শক, শ্রোতাদের মুখে। এসবের মধ্যেই নায়িকার সঙ্গে খাদান ছবি গানে গলা মেলাতেও শুরু করলেন প্রশাসনের কর্তারা। নায়িকা ইধিকা নিয়ে আবেগ-আনন্দের ঠেলায় জেলাশাসককেও কিছুক্ষণের জন্য স্বাগত ভাষণ বন্ধ রাখতে হয়। নেতা,মন্ত্রী,আমলা, নায়িকার মিলনমঞ্চে চাঁদের হাট বসেছে- এমন ঘোষণাও করা হল। কিন্তু আসল চাঁদের দেখা মিলল না। যাঁর তবলা বা সুরসঙ্গতে অনুষ্ঠানের সূচনা হওয়ার কথা ছিল, সেই বিক্রম-চাঁদই আড়ালে রয়ে গেলেন। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন সহ উদ্বোধনের মূল অনুষ্ঠানে মন্ত্রী,নেতা, আমলাদের কার্যত মধ্যমণি হিসেবে দেখা গেল ‘খাদান’ ছবির নায়িকা ইধিকা পালকে।

তার পর মঞ্চ ছেড়ে মেলা প্রাঙ্গণে অন্য একটি অনুষ্ঠানের দিকে পা বাড়াতেই ইধিকার পিছু নিল প্রায় সকলেই। মঞ্চের সামনের সব ভিড়টাই টেনে নিলেন খাদানের ওই নায়িকা। আসলে এই মেলা প্রাঙ্গণে ছবির প্রচারটাও সেরে ফেললেন প্রচারটাও সেরে ফেললেন তিনি, এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। যাইহোক, তার কিছুক্ষণ পর গুটিকতক শ্রোতা, দর্শককে সাক্ষী রেখে মঞ্চে উঠলেন বিশ্ববরেণ্য শিল্পী বিক্রম ঘোষ। একজন সামান্য শিল্পীর মতো তাঁকে সংবর্ধনা দিয়ে উদ্যোক্তারা মুখরক্ষা করলেন। এরপরেই সুর,ছন্দ,তাল, যন্ত্রানুসঙ্গে রীতিমতো বিক্রম দেখাতে শুরু করলেন বিশ্ববরেণ্য এই শিল্পী সহ তাঁর সহযোগীরা। দারুণ, দুর্দান্ত। নতুন আঙ্গিকে সুরের ঝংকারে মেলা মাতালেন তিনি।
একেবারে সাদামাটা লোকজনেদের কাছে বিক্রম ঘোষের খুব একটা পরিচিতি নেই। সুরসঙ্গীতপ্রেমী মানুষ বা মেলার বিশিষ্টজনেরা তাঁকে জানেন না বা চেনেন না বললে কি ঠিক হবে? দেশদুনিয়া কাঁপানো শিল্পী বিক্রম ঘোষ। দেশবিদেশের বহু নামীদামী পুরস্কার জয় করেছেন তিনি। লন্ডনের রয়াল অ্যালবার্ট হল সহ বিশ্বের নামীদামী বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ তারকাশিল্পী হিসেবে দাপিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। ক্রীড়াঙ্গণ থেকে শুরু করে তার সুরসৃষ্টিতে মেতে উঠেছে সংস্কৃতি অঙ্গন। পরিচালক,সুরকার হিসেবে তিনি সমাদর পেয়েছেন বিশ্ব দরবারে। সংস্কৃতি মনস্ক বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আসল রত্ন চিনতে ভুল করেননি। বঙ্গ বিভূষণের পাশাপাশি তাকে সঙ্গীত মহা সম্মান প্রদান করে রাজ্য সরকার। কিন্তু সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণার সৃষ্টিশ্রী মেলাতেই কি না সামান্য শিল্পীর মতো এলেন, গাইলেন, চলে গেলেন! উদ্বোধনের মূল মুহূর্তে তার মুখটা সামনে আনা গেল না? প্রশ্ন তুলছেন শিল্পাঞ্চলের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন। সেক্ষেত্রে দুর্গাপুরের শিল্পরসিক, সংস্কৃতি পাগল ওইসব মানুষজনের ভাবাবেগকে কি অস্বীকার করা যায়? না, যায় না।

মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাকে রাখা গেলে ভালোই হত। একথা উদ্যোক্তারাই স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে প্রশাসনের আধিকারিকদের উপস্থিতিতে বিক্রম ঘোষকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন মহকুমাশাসক সৌরভ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, উদ্বোধনের মূল শিল্পী হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন বিক্রম ঘোষ। সেক্ষেত্রে মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাকে ব্রাত্য রেখে স্রেফ সৌজন্য বা নিয়মরক্ষার সম্মান প্রদর্শন কি যথোচিত কাজ হয়েছে? শিল্পাঞ্চলের শিল্পরসিকদের মতে, নিয়মরক্ষার এইটুকু সম্মান প্রদর্শন না করলে ভালই হত। বিক্রম ঘোষের মতো বিশ্ববরেণ্য শিল্পীকে নিয়মরক্ষার সম্মান প্রদর্শন অসন্মানের নামান্তর মাত্র। সেক্ষেত্রে সৃষ্টিশ্রী মেলায় সৃষ্টিশীল শিল্পীর এই উপেক্ষা প্রাপ্য ছিল? হাতের কাছে পেয়েও বিশ্ববরেণ্য এই শিল্পীর শিল্পসত্তাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারলাম না, এ লজ্জা কি শিল্পাঞ্চলের নয়? প্রশ্ন তো উঠবেই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button